সংশয় তো ছিলই। আদৌ কি শীত থাকবে ? বৃষ্টি হবে নাতো ?
সংশয়ের কারণ তো ছিলই। প্রাজ্ঞরা বলেন "মাঘের শীত, বাঘের গায়"। মকর
সংক্রান্তি পেরিয়ে যাবার পরেও মাঘের শুরুতে
জানা গেল বাঘেরা সোয়েটার ছাড়া ই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকে ২৪শে জানুয়ারী এগিয়ে আসছে। প্রাজ্ঞবাক্য কি মিথ্যে হবে?
আমরা রীতিমত শঙ্কায়।
অবশেষে প্রকৃতি দেবী মুচকি হাসলেন। বাইশ থেকেই পারদ নামতে শুরু করলো। চব্বিশের সকালে হিম শীতল হাওয়াতে বাসের জন্য অপেক্ষমান জনতা আপাদমস্তক পশমলাঞ্ছিত। তারা বাসে করে গ্রীনল্যান্ড যাবেন না অছিপুর ,বোঝে কার সাধ্যি! আকাশে মেঘের আড়ালে সুর্যকিরনের আভাস । একে সোনা ,তায় সোহাগা। আমাদের আর আল্হাদের অন্ত নেই।
 |
চল যাই চলে যাই |
বাস চলতে শুরু করার পর পরই শ্রী নেপাল সোম ও শ্রী সঞ্জয় সরকারের সৌজন্যে কেক, মুগের ডাল ভাজা আর কমলা লেবু হাজির। বাস চললো তারাতলা রোড ধরে বজবজ এর দিকে। এসে গেল বজ বজ ট্রাঙ্ক রোড। পেরিয়ে গেলাম বেসব্রীজ আর বাটানগর। তারপর মহেশতলা আর পুজালী পৌরসভা অঞ্চল। ইন্ডিয়ান অয়েল এর শোধনাগার ডান দিকে রেখে বাস ঘুরলো বাঁয়ে। কোথায় ই বা বন্ , কখনই বা ভোজন? শুরুর খাবার তো হজম হয়ে গ্যাছে বাস যাত্রা আর আড্ডায়। ভিড়ের বাজার দোকানের গা বাঁচিয়ে বাস এগোতেই অবশ্য গ্রামের চেহারা চোখে এলো। Blue Diamond Garden অব্দি বাস না যাওয়ায় আমরা মেঠো পথে এগিয়ে,শেওলা ঢাকা পুকুর ,চোখ জুড়ানো সবুজ মাঠ আর কুঁড়ে পেরিয়ে হাজির অকুস্থলে।
 |
কে আছো দাঁড়ায়ে দ্বারে |
Blue Diamond এখনো বাগান হয়ে ওঠে নি।তবে জায়্গা যথেষ্ট। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছপালা। রঙ্গীন ছাতার নীচে টেবিল-চেয়ার লাগিয়ে বসার ব্যবস্থা। সবুজের প্রাচুর্য্য।
 |
লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে রে লাল নীল সবুজের মেলা রে |
 |
আয় আয় ছুটে আয় খেলবি যদি আয় নতুন সে এক খেলা রে |
জানা গেল কাছেই গঙ্গা।
অতএব গঙ্গাযাত্রা দিয়েই শুরু হলে ক্ষতি কি?
বহমান গঙ্গা। কি তার বিস্তার! এই সৌন্দর্য্য আমার বর্ননাতীত। শংকরাচার্য র গঙ্গাস্ত্রোত্র মনে পড়িয়ে দেয়।
 |
গঙ্গা আমার মা |
দেবী সুরেস্বরি ভগবতী গঙ্গে , ত্রিভুবনতারিণি তরলতরঙ্গে।
শঙ্করমৌলিনিবাসিনি বিমলে , মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে।
প্রাত:রাশের তাগিদে গঙ্গাসঙ্গ ছেড়ে এলাম। কচুরি ,আলু-ফুলকপির তরকারি আর বোঁদে। নি:সন্দেহে ভারী ভোজন।
 |
খেতে দাও আমায় ডেকো না |
এরপর এলাকা পর্য্যবেক্ষণে বেড়িয়ে পৌঁছেছি চীনা মন্দিরের দরজায়।
 |
পুকুরপাড়ে লেবুর তলে |
এই চীনা মন্দিরের প্রসঙ্গে এসে পরে অছিপুরের গোড়ার কথা। প্রায় দু' শো তিরিশ বছর আগে যখন কলকাতার ই অধিকাংশ ছিল জঙ্গলে ঢাকা , তখন ৩০ কিলোমিটার দূরের এই অঞ্চল অগম্য ছিল মনে হয়। হয়তো বা জেলেদের কিছু বসতি থেকে থাকতে পারে। কি ছিল অঞ্চলের নাম ? জানা নেই। সেই
সময়ে জলপথে হাজির হলেন অচিউ টং নামে এক চায়ের ব্যবসাদার। তিনি ওয়ারেন হেস্টিং সাহেবের সরকারের থেকে ৬৫০ বিঘা জমি জমি নিলেন বার্ষিক ৪৫ টাকা ভাড়ায় । তাতে আখের খেত আর চিনির কল তৈরী হল। এখানে কাজের জন্য উনি একদল চীনা কর্মচারি ও নিয়ে এলেন। ভারতে প্রথম চীনারা বসতি করলেন। সাহেবের নাম দেশি উচ্চারনে দাঁড়ায় "অছি ", তাই আছিপুর নাম। ১৭৮০ সালে স্থাপিত এই মন্দিরে দুই দেব-দেবী র অধিষ্ঠান। তাঁরা হলেন টুডি গং আর তাঁর স্ত্রী টুডি পো। ধরিত্রীর দেবতা ও উর্ব্বরতার দেবী। আমাদের জগদীশ্বর ও পার্বতী যেন। দূর্ভাগ্যবশত: চিনিকল চালু হবার অল্প দিন পরেই অচিউ টং মারা যান। এলাকার চীনা বাসিন্দারা কলকাতায় চলে আসেন। বিভিন্ন পেশায় লেগে যান। এখন ওখানে কোনো চীনা বাসিন্দা নেই। আমি আর সঙ্গীরা অবশ্য মন্দিরের ভিতরে যেতে পারিনি। গেটে তালা দেখে ফিরে এলাম।
 |
দেবতা মন্দির দ্বারে |
আবার Blue Diamond গার্ডেন এর চত্বর। নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্যই কিছু খেলার আয়োজন। শুরু হলো কুইজ কনটেস্ট দিয়ে। গোটা তিরিশের মত প্রশ্ন। মূলত: সিনেমা আর কিছুটা বাংলা সাহিত্যের মিশেলে তৈরী। কুইজ মাস্টারের কোনো চকোলেট পরে রইল না শেষে। পরে পাসিং দি বাক। এতে ছয় জন জিতলেন। শেষে বিশেষ বিশেষ শব্দ দিয়ে গানের লড়াই। তাতে জিতলেন দুটি দল।
 |
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি |
খেলা শেষে দিপ্রাহরিক ভুড়ি ভোজন। রঙীন ছাতার নীচে লাল টেবিল-চেয়ার। ভাত ,মুগের ডাল ,আলুভাজা ,কাতলা মাছ ,মুরগির মাংস , খেজুরের চাটনী ,পাপড় আর নতুন গুড়ের রসগোল্লা।
 |
ভক্ষনেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস |
ভোজন শেষে আবার গঙ্গাতীরে যেতে মন চাইলো। অপরান্হ বেলা। স্রোতে এখন ভাঁটার টান। সূর্য্যি ঠাকুর ও হেলে পড়ছেন। অনেকটা সময় কাটিয়ে এসে জানলাম যথেষ্ট নাচ হয়েছে, যা আমার দেখা হয় নি।
 |
আর কত দুরে নিয়ে মোরে |
 |
পথের শেষ কোথায় |
 |
নদীর ঘাটের কাছে নৌকা বাঁধা আছে |
 |
পড়েছে নধর বট হেলে ভাঙ্গা কুলে
|
সুহাসদা প্রথামত: অলককে নিয়ে টেবিল সাজিয়ে হাউসি র টিকিট বিক্রি শুরু করেছেন। ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী রা জিতলেন। আমি তথৈবচ। চিরকাল নিস্ফলের দলে।
 |
খেলা ভাঙার খেলা |
কিছুই কি পেলাম না? পেলাম বৈকী! সুন্দর নিসর্গ। বাঁধন ছাড়া সাহচর্য। প্রাণ খোলা হাসি।একটা উজ্জ্বল দিন। এতটা লেখার খোরাক। আর কি চাই?
 |
তখনো অস্ত যায়নি সূর্য |
এবার যাবার পালা। পিছনে পরে রইলেন মা গঙ্গা।শ্যাওলা ছাওয়া, কলাগাছে ঘেরা পুকুর,ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুঁড়েঘর। সর্বপরি অছিপুরের বর্ণময় ইতিকথা।
 |
শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা |
বাস ছেড়ে দিল। কাল আবার বাজার করা আছে।
(শ্রী সুজিত বিশ্বাসের আগ্রহে আর নিজের তাগিদে লেখা। শ্রী সুনীল দাস ও শ্রীমান শুভজিত বিশ্বাসের তোলা ছবি ব্যবহার করেছি। তাদের, মুখ্য উদ্যোক্তা শ্রী অলক সিনহা আর বনভোজনে যারা অংশ নিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানাই )
Comments