দিদির বিয়ে

১৯৫৬ সাল।আমি ক্লাস থ্রী তে উঠে গিয়ে নিজেকে বেশ বড় মনে করছি।আমাদের কালীঘাটের বাড়ীতে একজন সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক এলেন বাবার কাছে। বাবা, মা এবং দাদার সাথে আলাপ করালেন । বাবা ওঁদের বাড়ী র গৃহ চিকিৎসক । ওঁকে দেখেই দিদি আর আমরা যারা দিদির বিশেষ অনুগত ভাই এবং ছোড়দি ছাদের সিঁড়ি র বাঁকে আত্মগোপন করেছি । দিদির তেমনি নির্দেশ । দিদি মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল নীচে। উদ্দেশ্য কি কথা বার্তা হচ্ছে তাঁর হদিশ করা। আমরা সাত হাত জলে।
এবার দাদা উপরে এলেন দিদি কে নিয়ে যেতে।
দিদি অরুণ বর্ণ মুখে মাথা নীচু করে দাদার সঙ্গে বাবার ঘরে ঢুকে গেল। থ্রী র আমি আর ফাইভের সোনাদা কিছু না বুঝে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি । ছোড়দি কিন্ত সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাবার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছে । সে ও থ্রী , কিন্ত মহিলা তো ! ঔৎসুক্য অনেক বেশী। ছোড়দি ই এসে খবর দিল যে দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে । যিনি এসেছেন তিনি পাত্রের বড়দাদা , নাম শ্রী চিত্ত রঞ্জন ভট্টাচার্য ।
তারপর থেকেই হুল্লোড়ের শুরু। দিদির প্রাত্যহিক কাজকর্ম যার বেশীর ভাগটাই আমাদের নিয়ে, তাতে ভাঁটা পড়ে গেল। আমাদের স্কুলে যাবার সময় তৈরী করে দেওয়া, আমাদের হোম টাস্ক দেখে দেওয়া, আমাদের কবিতা আবৃত্তি করানো, ছাদে আমাদের নিয়ে গাদি খেলা , আমাদের বায়না মত খেলনা বানিয়ে দেওয়া, দিদি আর করে উঠতে পারে না। মায়ের সঙ্গেই কাটায় সারাদিন। দিদির এতটা সান্নি্ধ্যে অভস্ত্য । তাতে কম পরে গেল আচমকাই।
বিয়ের আগে


এদিকে বাড়ী তে আত্মীয় সমাগম শুরু হয়েছে । সমবয়সী খুড়তুতো আর মামাতো ভাইদের নিয়ে একবার ছাদে একবার বাইরে দৌড়ে বেড়াচ্ছি, কিন্ত শিশুমনে কোথাও একটা অভাব বোধ কাজ করছে । গত সাতটা বছর দিদির সঙ্গ ছাড়া কাটে নি বড় একটা। পালন এবং শাসন দুটোরই কর্ত্রী ।
দাদা, ছোড়দা, প্রবোধ দা ( পিসতুতো দাদা) আর দাদাদের বন্ধুরা খুবই ব্যস্ত।বাবা ও।
বাড়ী র ছাদে একটা দিকে ম্যারাপ বাঁধা হল । ভাড়া নেওয়া হল নেপাল ভট্টাচার্য স্ত্রীটের কর্পোরেশন স্কুল।সবাই বলত ধর্ম দাস স্কুল । বিয়ের আগের দিন ১১ই জ্যৈষ্ঠ, বিকেল বেলা , ছোড়দা রা বাজার করে ফিরলেন শিয়ালদহ থেকে। একসাথে অত বাজার? বিয়ের বাজার দেখার অভিজ্ঞতা তো সেই প্রথম !
১২ ই জ্যৈষ্ঠ, সকাল সকাল মাছ নিয়ে এলেন আশা নন্দ দাস, তার ভাই আর ছেলে বীরেন। মাছ কাটা দেখতে দোতালার ছোট ছাদে ভিড় জমে গেল। বিরাট কাতলা মাছ দুজন তুলে ধরল আঁশ বঁটিতে। আর বাকীজন কাঠের হাতুড়ি দিয়ে মেরে মেরে প্রাথমিক টুকরো করে শুরু করে দিল মৎস্য বিভাজন। মিষ্টি র জোগানদার হারাণ মাঝির দোকান।
সন্ধ্যেবেলা বরযাত্রী রা এলেন সরাসরি ধর্ম দাস স্কুলে। বিয়ের অনুষ্ঠান ওখানেই হল । তারপর রীতিমত পাত পেড়ে খাওয়া । মেনু ? সে আমলে যেমনটি হত। লম্বা ফালি করা বেগুন ভাজা, নটে শাক, লুচি , ছোলার ডাল, পটলের ডালনা, ঘি-ভাত, মাছের কালিয়া, রসগোল্লা, সন্দেশ ও দই । খাওয়ার পরে পান।সেটি বাড়ীর মহিলাদের হাতে সাজা।
আমার খুব ইচ্ছে পরিবেশন করার। উপরোধে ছোড়দা দ্রব হয়ে আমার হাতে পিতলের জলের জাগ দিলেন। আমি শিশুকাল থেকেই অকাজের গুরুমশাই , জল ভর্তি জাগ সামলাতে না পেরে জল ফেলে দিলাম এক নিমন্ত্রিতের গায়ে।তিনি রোষ কষায়িত নয়নে তাকাতে গিয়ে ডাক্তার বাবুর ছেলে দেখে সস্নেহে হাসলেও ছোড়দা আমাকে বরখাস্ত করলেন তক্ষুনি ।
অনেক রাতে আমরা ফিরে এলাম বাড়ীতে । হাঁটা পথ । ছাদের উপর ডেকরেটার ফরাশ পেতে দিয়েছিল। তার উপর শুয়ে খোলা আকাশের নীচে আমরা রাত কাটালাম। তখন কলকাতার আকাশে অনেক তারা ছিল। তাদের দেখতে দেখতে ঘুমোতে রাত হল ।
পরের দিন সকালে আলাপ হল আমার জামাই বাবু শ্রী সত্য রঞ্জন ভট্টাচার্য র সঙ্গে । অত্যন্ত সুদর্শন। আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় নি। উনি হেসে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন । আমার নাম শুনে কাছে টেনে নিয়ে বললেন , আমাদের যখন এক ই নাম তাহলে আমরা তো বন্ধু হলাম । এতটা সম্মান আশাতীত। জামাই বাবু কিন্ত যতদিন আমাদের মধ্যে ছিলেন, এই প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন । আমার প্রতি তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল।
বিকেল হতে না হতেই কান্নার রোল। সবারি চোখ জল।বোঝা গেল দিদি আর জামাই বাবু সোদপুর নামক কোন জায়গায় ওঁদের বাড়ী তে যাবেন। এতে সবার, এমন কি দাদার মত বড় লোকের ও, কান্না র কারণ কি? যাবে, নিশ্চয় আবার চলে আসবে। দিদি আমাদের ছেড়ে থাকবে কি করে ?
প্রায় সন্ধ্যে বেলা দাদা একজন ফটোগ্রাফার নিয়ে এলেন। দিদি আর জামাই বাবুর ছবি তোলার জন্য। তিনি বিধান দিলেন পশ্চিম মুখ করে দাঁড়াতে আর পিছনের গাছ পালা আড়াল করতে । চট করে চিলেকোঠার ব্যবহার করা একটা বিছানার চাদর নিয়ে এলেন ছোড়দা । তাড়া আছে, দেরী হয়ে যাবে।
অতঃপর ফটোগ্রাফার ব্যাগ খুলে বার করলেন একটি ট্রাইপড আর বেশ বড় সাইজের ক্যামেরা। এর আগে দেবতোষ দা' র বক্স ক্যামেরা দেখেছি, কিন্ত ইনি অন্য রকম । ট্রাইপডের উপর ক্যামেরা লাগিয়ে একটা কালো কাপড়ে সবটা ঢেকে দিয়ে একবার পাত্রপাত্রী কে দেখে নিয়ে নিজেই ঢুকে পড়লেন কাপড়ের আড়ালে। তারপর একটা শব্দ । ব্যাস্‌ । ছবি তোলা শেষ। এটার নাম যে প্লেট ক্যামেরা , সেটা কলেজে থাকাকালীন ডি, রতনের কাছে জানি।
যাবার সময়

দিদি - জামাই বাবুকে ট্যাক্সি অব্দি এগিয়ে দিতে আমার শোভাযাত্রা করে গেলাম। দিদি চলে গেল।
বৌ ভাতের দিন সোদপুর গেলাম আমরা সবাই।কনের সাজে দিদি কে খুব সুন্দর লাগছিল। দিদিকে ঘিরে ছিল অচেনা বড়রা। ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞাসা করি , কবে আসবি রে, দিদি? ভিড় পেরিয়ে যেতেই পারি নি।
তারপর কত দিন মনেই থাকতো না, যে দিদি কালীঘাটের বাড়ী তে নেই।বানান আটকালে দিদি কে খুঁজতে চাইতাম। সাত বছরের ছেলেমানুষ মনটা অনেক সময় নিয়েছিল বুঝতে যে তার দিদি পরের বাড়ী র লোক হয়ে গেছে।
দিদির বিয়ের সময় বয়স ছিল ১৬ বছর । আমাদের অশেষ ভাগ্য যে দিদি এখনো আমাদের মধ্যে আছেন। তবে আমার বাল্যবন্ধু জামাই বাবু কয়েক বছর আগে চলে গেছেন।
দুটি ছবি দিয়েছি। প্রথম টি দিদির বিয়ের আগে ছোটো ভাই দের ও বোনের সাথে। অপরটি সেই প্লেট ক্যামেরায় তোলা ১৯৫৬ সালের মে মাসে।

Comments

Popular posts from this blog

Raibahadur

Ex-Meconian's PICNIC at PAT'S COTTAGE at Sonarpur, on 3rd January 2016

People's Mandate