গঙ্গার তীর



কবিগুরু লিখেছিলেন , দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া , একটি ধানের শিসের উপরে একটি শিশির বিন্দু। এটা আনেক টাই বিনয় । উনি যে গভীর অন্তর দৃষ্টি তে   বাংলার শিশির বিন্দু বা ধানের শিস লক্ষ্য করেছেন, খুব বেশি জন তা পারেন নি।
তবে আমি তো নিতান্তই লোহাকাটা, ধানের শিসের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও শিশির বিন্দু দেখে উঠতে পারিনি। দীর্ঘ কাল সোদপুরে বাস করেছি। ব্যারাকপুর বেশী দূর নয় । গেছি ও। তবে কাজে, দেখার মতলবে নয়। বছর দুয়েক আগে বন্ধুবর আশোক ও শান্তা আমাদের নিয়ে গেল রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুলে। সেখান থেকে গান্ধীঘাটে। অনেক আগে গান্ধী ঘাটে এসেছিলাম। তখন আশেপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল । এখন সেখানে দাঁড়িয়ে মালঞ্চ, WBTDC র ট্যুরিষ্ট লজ। একেবারেই গঙ্গা র পার ঘেঁসে।এই পথ ধরেই ভাগীরথী চলে গেছেন গঙ্গা সাগরে কপিল মুনির  আশ্রমে।

মালঞ্চ




" নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভুমি,
  গঙ্গার তীর অতি সু-নিবিড় জীবন জুড়ালে তুমি"।

মনে হল আসা চাই মালঞ্চে।
সেই ভাবনা কাজে লাগাতে সময় লাগলো প্রায় দেড় বছর। গত আগষ্টের  ১৩ তারিখ  আমি সস্ত্রীক  এলাম মালঞ্চে। বাড়ি থেকে উবেরে শিয়ালদহ । শিয়ালদহে  দাঁড়িয়ে থাকা একটি বর্ধমান লোকালে চেপে ব্যারাকপুর । বেশ জমকালো আর ঐতিহ্য বাহী স্টেশন।
হবারই কথা। প্রাচীন বর্ধিষ্ণু স্থান ব্যারাকপুর । প্রাচীন কাব্যে বা নথিপত্রে জায়গাটি চণক নামে উল্লেখিত। তারপর পলাশীর যুদ্ধের পর যখন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে চায় তারা ঘাঁটি বানালো এ অঞ্চলে। নাম পালটেছে ইতিমধ্যে। মুঘল সম্রাট দের নথিতে তখন এ মহালের নাম " বরবকপুর "। নোনা চন্দনপুকুরের জমিদার বংশ এই মহাল দেখাশোনা করে । ইংরেজরা নবাবের কাছ থেকে এই অঞ্চল আদায় করে নিল। ১৭৭২ সালে তৈরি হ'লো    ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী র প্রথম ক্যান্টনমেন্ট  বা সেনা ছাউনি। গোরাদের ব্যারাক শব্দ থেকেই ব্যারাকপুর।

 ইংল্যান্ডে কাঁঠাল না হলে কি হবে  ইংরেজ রা কিন্ত ভারতবাসী র মাথায় শুরু থেকেই কাঁঠাল ভেঙেছে । ১৭৫৭ র পলাশীর যুদ্ধ জিতেছে বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তায় । কোনো যুদ্ধ না করেই । তারপর থেকে সারা ভারতে আধিপত্য স্থাপন করেছে দেশী সৈন্য দের সামনে এগিয়ে দিয়ে। পরের দুশো বছর দেশ সামলেছে মুলতঃ দেশী সিভিলিয়ান রা আর দেশী পুলিশ বাহিনী আর একের পর এক বিদেশ জয়ে ব্যাবহৃত  হয়েছে দেশী সেনা বাহিনী । সেই বাহিনী জায়গা দিতেই সেনানিবাস।প্রথমে ব্যারাকপুরে, তারপর দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

শুধু সৈন্য ন্য, শ্রমিক ও  । দেশী আড়কাঠি  লাগিয়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে জাহাজে ভারতীয়দের ক্রীতদাসের মতো নিয়ে গেছে বিদেশের উপনিবেশে । তারা  বিদেশে প্রতিকুল পরিবেশে বিভিন্ন চাষের কাজ করেছে, রেলওয়ে, ব্রীজ, রাস্তা তৈরি করেছে ।জঙ্গল কেটে নগর বানিয়েছে। তারা নাকি চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। আসলে দ্বীপান্তর পাওয়া দেশীয়, যারা কোনদিনই আর দেশের মাটিতে ফিরতে পারে নি। পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গার এরকম নজির ইতিহাসে মেলা ভার।

ফিরে আসি স্টেশনে । ওখানে সার দিয়ে অটো আর টোটো। বি টি রোড দিয়ে  গিয়ে ডানদিকে রাস্তা । কিছুটা গিয়ে  গান্ধীঘাট। তার গায়ে গায়েই মালঞ্চ। ঘর বাছাই আর বুকিং অনলাইনে।দোতালার পরিষ্কার সাজানো ঘর। সামনের জানালা দিয়েই দেবী সুরেস্বরী ভগবতী গঙ্গে।

গঙ্গার তীর 


স্নানাদি করে এলাম ডাইনিং হলে। সাজানো টেবিল,চেয়ার।হঠাৎ ই  গহন মেঘের ছায়া ঘনা্ইযা আসে  । তারপর    ঘোর  বর্ষণ গঙ্গা র বুকে।ভয়ংকর সুন্দর দৃশ্য।

ঘোর ঘনঘটা 

খুব দীর্ঘ স্থায়ী নয় ,তবে মন গ্রাহী বটে। এ রকম্ তো রোজ কপালে জোটে না।
ঝর ঝর ধারা আজি উতরোল, নদী কূলে কুলে ওঠে কল্লোল।

বর্ষণ মুখরিত 

শহীদ মঙ্গল পাণ্ডে সঙ্গত কারণেই ইতিহাসে জায়গা পেয়েছেন। এই ব্রাহ্মণ সন্তানই ১৮৫৭ সালের মার্চে সঙ্গী সেপাইদের নিয়ে বিতর্কিত এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন । অস্ত্র ধারণ করেন  ইংরেজ সেনানায়কদের বিরুদ্ধে। ফলস্বরূপ ফাঁসি হয় মঙ্গল পাণ্ডের।  ঐতিহাসিকদের মতে এই ঘটনা সে বছরের এপ্রিল মাসে সারা ভারত ব্যাপী সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা করে। শহীদ  মঙ্গল পাণ্ডে নামাঙ্কিত উদ্যান আছে , সেখানে তার স্মৃতি স্তম্ভ  স্থাপিত। ২০০৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের ১৫০ বর্ষ পূর্তিতে স্ট্যাম্প বেরিয়ে ছিল তার স্মরণে।

শহিদ স্মৃতি 


ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ ১৮৫৭ র আগেও হয়েছিল।১৮২৪ সালে। প্রথম বার্মা যুদ্ধে সেনানায়কদের পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সেনাদের এগিয়ে দেওয়া। কারন বর্মী সেনারা মুখোমুখি লড়াইতে অপ্রতিরোধ্য। সেই মতো সৈন্যদের জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিতে হয়।সেপাই বিন্দি তেওয়ারীকে মুখপাত্র করে একটি ডিভিশনের সেনারা জাহাজে উঠতে অস্বীকার। ফলতঃ বিন্দি তেওয়ারীর ফাঁসি হয় আর বাকী সেপাইদের তোপের মুখে উড়িয়ে দেয় কতৃপক্ষ। দূঃখের কথা বিন্দি তেওয়ারী আর তার সঙ্গীদের আত্মত্যাগ ইতিহাস মনে রাখে নি। যে গাছটির নীচে এই শিবমন্দির ,সেই গাছ থেকেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল শহীদকে।Public Execution. অতি  সভ্য জাতির অতি প্রিয় নৃশংস শাস্তি।

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে 
ব্যারাকপুরে একসময় লাট সাহেবের বাসস্থান ও প্রশানিক অফিস ছিল। লাটসাহেব মাঝে মাঝেই যাতায়াত করতেন। তবে সিপাহী বিদ্রোহের পরে সম্ভবতঃ আর নিরাপদ মনে করেন নি।  ওখানে সেনাবাহিনীর কিছু দপ্তর আছে। আর আছে ভারতের প্রথম পুলিশ ট্রেনিং কলেজ। টুরিস্ট বাংলোর একপাশ দিয়ে যাওয়া যায়। তবে ভিতরে যাবার বিধি নিষেধ আছে। আমাদের ATM এ টাকা তোলার দরকার ছিল। তাছাড়া আমরা দৃশ্যত খুব একটা বিপদ্দজনক না মনে হওয়ার ফলে ভিতরে গেলাম।বিশাল জায়গা। সাজানো বাগান।পরিষ্কার রাস্তা।আর সুন্দর ঘরবাড়ী। ছবি তুলতে মানা।     জায়গাটার নাম এখনো লাট বাগান।

অন্নপূর্ণার মন্দির 
  পরের দিন বৃষ্টির  সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই বেরিয়েছিলাম। বেরিয়ে দেখা দেবী  অন্নপূর্ণা র মন্দিরের। এই মন্দির রানী রাস মণি র এক কন্যার প্রতিষ্ঠিত । বিটি রোড দিয়ে    গান্ধীঘাট রোডে  ঢুকতেই বাঁ হাতে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে। মন্দির চত্বরে দুধারে বারো টি শিব মন্দির।মাঝখানে দেবীর মন্দির। মন্দিরের গঠন শৈলী অনেকটাই দক্ষিণেশ্বরের দেবী ভবতারিণী র মন্দিরের মত। কাছেই রাস মণি নামাঙ্কিত স্নানের ঘাট।
মন্দির চত্বর 


ব্যারাকপুরে নিশ্চয় আরো জায়গা আছে  দেখার মতো। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আশ্রম তার অন্যতম। সেখানে আগে অবশ্য একাধিকবার গেছি। এবার ও যেতে পারলে ভাল লাগতো। যেখানে যাওয়া হয় নি তা হলো নোনা চন্দনপুরের জমিদার বাড়ী। কিন্ত বৃষ্টি ছিল। তাই ঘরে বসে বা বাইরে নেমে বৃষ্টির মধ্যে গঙ্গার ভয়ংকর রূপ দেখা ই ঠিক মনে হল।

১৫ই আগস্ট সকালে আমরা রওনা হলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতা দিবসে রাজ্যপাল আসবেন গান্ধী ঘাটে মাল্যদান করতে। তাই অটো পেতে দেরী হল। স্টেশনে এসে আর এক সমস্যা। ছুটির দিন ট্রেন কম। সবই দূরপাল্লার। তাই ট্রেনের যাত্রা সুখের হয় নি।
পিছনে রইল ব্যারাকপুর , শ্রীরামপুরের দিকে মুখ করে।  সংসারে ফিরে আমরা আবার সেই কচ্ছপ।

Comments

SATYANESWAN said…
bhalo laglo pore - jayasree

Popular posts from this blog

Raibahadur

Ex-Meconian's PICNIC at PAT'S COTTAGE at Sonarpur, on 3rd January 2016

People's Mandate