কুইন্সটাউন

প্লেন মাথা নীচু করে এগোতেই ধেয়ে  এলো মেঘে ঢাকা বরফে ছাওয়া পর্বতের সারি। এই তবে সেই রিমার্কেবল রেন্জ। সাদার্ন আলপাইন পর্বতমালার  পর্বতশ্রেনী। স্বনামধন্য। সৌন্দর্যে তো বটেই, অব্স্থিতিতেও।। সরাসরি নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডএর উত্তর থেকে দক্ষিণ অবধি বিস্তৃত।এই মহাস্থবির দীর্ঘ পথে অনেক নদী,জলাশয়,জঙ্গল ও জলপ্রপাত কে জন্ম দিয়ে দ্বীপকে স্বর্গ-সমতুল্ করেছে।

 মুহুর্তের ব্যবধানে হাজির কুইন্সটাউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। একথালা ভাতের ভিতর ডালের জায়গা করলে থালাটার যে চেহারা হয় এ তেমন ই।  পর্বতে ঘেরা ছিমছাম সমতল। বাতাসে স্বাস্থ্যের স্পর্শ।

এবার সবুজ ট্যাক্সি তে চেপে পাকদন্ডি বেয়ে অস্থায়ী আস্তানায়। মোটেল। নাম ক্যাপেলস কোর্ট। বাংলা অনুবাদে আস্তাবল। সাহেবরা কি ঘোড়া আর মানুষে তফাত করে না? এই মোটেলের মালিক আর কর্মচারী মিলিয়ে সাকুল্যে দুজন।কিং দম্পতি। রবিন আর কে। তারাই আপ্যায়ন করে আবার  তারাই ঘর সাফাই করে। আমাদের দু-কামরার আপার্টমেন্ট। বসার  ঘরে দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানালা দিয়ে নজরে পারছে লেকের কোল ঘেঁষে কুইন্সটাউন হিল। হিলের উপর উঠা নামা কাছে গন্ডোলা।

  রবিনের কাছে প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে আর জিনিষপত্র রেখে এবার গন্তব্য এসপ্লানেদ। চড়াই ধরে নেমে বাঁক ঘুরে এগিয়ে গেলে চৌমাথা। সোজা ডান-বাঁয়়ে সাজানো দোকানের সারি।কুইন্সটাউন শপিং মল । শপিং মলের প্রান্তে লেকের দিকে মুখ একটি মূর্তি। প্রথম দর্শনে তাইতো  মনে হয়েছিল। মূর্তি হাতছানি দিয়ে ডাকতেই ভুল ভাঙলো।  সেজে আছে মজা করে। সামান্য কিছু দিলে ছবি তুলবে সাথে। লেকের ধার ধরে এরকম হাজার কান্ড। অনেকটাই আমাদের মেলার মতো।কেউ ম্যাজিক দেখাচ্ছে , কেউ বা বাজনার সাথে নাচগান করছে, কেউ বা এঁকে দিচ্ছে পোট্রেট।  সকালের কাছেই একটা পয়সা র বাক্স রাখা। ছাত্র-ছাত্রী যারা এখানে বেড়াতে আসে, তারা এভাবে খরচের রেস্ত যোগাড় করে।

 লেকের ঠিক মুখেই মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছেন উইলিয়াম গিলবার্ট রিস। সঙ্গে তাঁর ব্যবসার পণ্য, মেরিনো নামের বিখ্যাত ভেড়া। ভাগ্যানেষ়ী রিস তাঁর আত্মীয় নিকোলাস ভন তুজেলমানকে নিয়ে ১৮৬০ সালে এ অঞ্চলে হাজির হন। ওরাই প্রথম ইউরোপিয়ান যাঁরা এই উপত্যকায় পা রাখেন। ভেড়া আর উল তৈরী করে আর চালান করে ভাগ্য ফেরান ওরা। ওদের ব্যবসা কে ঘিরেই গড়ে ওঠে এই জনপদ। রিস কেই কিউই রা বলেন কুইন্সটাউন এর জনক।ইউরোপিয়ানদের অনেক আগেই কিন্ত পলিনেশিয়ানরা ( পরবর্তী কালে যাদের মাওরি বলে জানি) এসেছিলেন এখানে বসবাস করতে। তবে তারা থাকতে পারেন নি। দক্ষিন দ্বীপের শীত তাদের কাবু করছিল। তাছাড়া  এখানের মাটিতে রাঙ্গাআলু ( মাওরি ভাষায় কুমারা ) ফলেনি আর কুমারা ই তাদের প্রধান খাদ্য। মাওরিদের সমৃদ্ধ ভাষা থাকা সত্বেও লিপি ছিল না। তাই তাদের আবিষ্কার গাথাতেই থেকে গ্যাছে।তারা পশ্চিমী সভ্যদের মত নিজেদের ঢাক ও পেটাতে জানতেন না। তাদের তাই কোনো মূর্তি ও নেই এ তল্লাটে।

 উইলিয়াম গিলবার্ট রিস ই যেন ওয়াকাটাপু  লেকের রক্ষক।তাকে পেরিয়ে ই যেতে হল লেকে। সাউথ আইল্যান্ডএর লেক ডিস্ট্রিক্ট এর প্রধান শহর কুইন্সটাউন। রিমার্কাবল পর্বত, জঙ্গল ,চোখ জুড়ানো সবুজ চারণ ভূমি আর বিশাল লেক - এই নিয়েই কুইন্সটাউন কুইন অফ টাউন। লেকের নাম ওয়াকাটাপু। নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম , কিন্ত সবথেকে দীর্ঘ। ৮৪ কিলোমিটার লম্বা। কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটার অব্দি চওড়া। গভীরতম তল ৩৭৭ মিটার। জলে নির্ভয়ে সাঁতার কাটে মাছ , চড়ে বেড়ায় পাখী। দিব্যি ঢেউ খেলে যায় জলে। আর গিরিরাজ রিমার্কেবল ? তিনি যেন লেক থেকেই মাথা তুলেছেন আকাশ ছুঁতে। ওয়াকাটাপু লেকের জল জোগান দ্যায় ডার্ট আর রীস নদী। এই বহতা হ্রদ গিয়ে মেশে কায়ারো নদীতে।


জানুয়ারী মাস তো এদের গরমের সময়। আকাশ নিতান্তই খামখেয়ালী। চোখ ঝলসানো নীল সহসাই ঢেকে  যাচ্ছে কালো মেঘের চাদরে। মিঠে রোদ্দুর  আর ঝিরঝিরে বৃষ্টির যাওয়া-আসা চলতেই থাকে। এসপ্লানেদ এর চত্বরে ঝাকড়া উইলো গাছ বৃষ্টি ভিজে সবুজতর হয়। ছাতা ছাড়া এই মরশুমে কুইন্সটাউনের রাস্তা-ঘাটে চলাই দায়। 

এই শহর সারা বিশ্বের কাছে নিউজিল্যান্ডের আডভেঞ্চার ক্যাপিটাল। নানা ধরণের রোমহর্ষক আর আমাদের নজরে আসুরিক খেলাধুলার আয়োজন লেকে, নদীতে , পর্বত শীর্ষে,আকাশে আর জঙ্গলে। রিমার্কেবলের গায়ে করোনেট শীর্ষে বিশ্বখ্যাত স্কি ফিল্ড। মে মাস থেকে ই বরফের সময়। দুঃসাহসীরা তাদের লটবহর নিয়ে হাজির হয দল বেঁধে। হোটেল মালিকদের নাওয়া খাওয়ার সময় থাকেনা। খরস্রোতা সটওভার আর কায়ারো নদীতে সারা বছর ধরেই চলে জেট বোট আর রাফ্টের স্রোতের উল্টো পথে যাত্রা। জেটের, রাফ্টের বা স্পিড বোটের দৌরাত্ব ওয়াকাটাপু লেকেও কম নয়। হাইড্রো আটাক নামের এক হাঙ্গর মুখী জেট আবার দ্রূত গতিতে জলের তলায় হারায়। উপরে উঠে আসার পরে তাদের চালকেরা যেন যুদ্ধ ফেরত বিদ্ধস্ত। তাই ই মজা এদের।সাইকেল ভাড়া করে আরোহী চলেছে পাহাড়ের চূড়ায়। এদের রোজকার খেলা বাঙ্গি জাম্পিং স্টেশন তো এখানে সেখানে। আকাশে চলছে গ্লাইডিং আর বেলুনের খেলা। যারা আর কিছুতে নেই তারা হাঁটা পথেই যাচ্ছে অনেক ট্রেল ধরে। আমরা বাবা দ্বিজুবাবুর নন্দলালের বংশধর ,চিত্ত মোটেই ভয় শুন্য নয়। আমরা দেখেই চোখ জুড়াই। আমাদের আডভেঞ্চার গন্ডোলা চেপে কুইন্সটাউন হিলের চূড়া থেকে নিসর্গ দর্শন। 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই উপত্যকায় ব্যবসা তুঙ্গে। জলপথে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের প্রয়োজন। তাই নিউজিল্যান্ড রেলওয়ের  বরাতে তৈরী হয়ে ১৯১২ সালে লেকের জলে ভাসলো ৫১ মিটার দৈর্ঘের স্টিমার টি এস এস আর্নশ্ল। এতে ভেড়া,গরু ,উল আর অনান্য দরকারি জিনিসের সঙ্গে মানুষ চলাফেরা করেছে অর্ধ্শাতাব্দির ও বেশি সময় ধরে। হয়ে দাঁড়ায় ওয়াকাটাপু লেকের প্রতীক - লেডি অব দি লেক। ১৯৬৮ তে বয়সকালে পরিতাক্ত হবার মুখে লীজ নিয়ে নতুন করে সারাই  করে রিয়াল জার্নি নামের এক সংস্থা।। এখন সারাদিনে বহুবার লেক ঘুরিয়ে দেখায় ভ্রমণকারীদের। টি এস এস আর্নশ্ল তে চড়ে  লেকের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর  অভিঞ্জতা ও অসাধারণ। শতাব্দী পেরিযেও চিরযৌবনা লেকের রাণী।

সুন্দরের বর্ণনা কখনই সহজ নয়। লেকের পাশে বসে জলের ঢেউ ,পাখীদের কোলাহল শুনতে শুনতে চোখ উপরে তুললেই নজরে পড়ে পাহাড় চূড়ায় আলোছায়ার খেলা। মাঝে মাঝেই জোরালো রোদ্দুরে দেখা দ্যায় বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। কখোন যে বেলা গড়িয়ে যায় খেয়ালই থাকে না. প্রলম্বিত দিনের শেষে যখন সূর্য় হেলে পড়েন পাহাড়ের আড়ালে , তখন সব আডভেঞ্চারের ছুটি। হাজারো পাখীর কলতান ডিঙিয়ে সন্ধ্যার শান্তি।



 উইলিয়াম গিলবার্ট রিস ছিলেন কট্টর বনিক আর বশংবদ রাজভক্ত। এই উপত্যকা তারও ভালো লেগেছিল। বৃটিশ রাজভক্তদের কাছে রাণী বর্ণ হিন্দুদের পঞ্চ দেবতার সমতূল্য।  তাঁকে প্রথমে না দিয়ে তো খাওয়া শুরু ই হয় না। তাই প্রথমে রাণীর ভোগ্য, তাই তারই নগর, কুইন্সটাউন। রিস এর বেশী আর কি ই বা  করবেন?

 কিন্ত কোনো পূর্ব দেশের কবি সে সময় এলে নির্ঘাত আওড়াতেন ,

স্বর্গ যদি থাকে কোথাও 

বিশ্বভুবন মাঝে ,

এই খানে তা, এই খানে তা, এই খানে তা আছে।

এই নান্দনিক সৌন্দয্য যথাযথ সম্মানিত হোত। হয় তো নাম দিতেন শ্রী নগর।


Comments

Popular posts from this blog

Raibahadur

Ex-Meconian's PICNIC at PAT'S COTTAGE at Sonarpur, on 3rd January 2016

People's Mandate